যারা জ্যোতিষের আলোচনা করেন ,তাদের মধ্যে অনেকেরই এমনি একটি ধারণা জন্মে যায় যে ,এ বিশ্বে যা কিছু ঘটনা ঘটেছে ,তা যত বড়ই হোক কিংবা যত ক্ষুদ্রই হোক,সবই গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাবে |
অনেককে এমন বলতে শুনেছি “বাপু হে , এই যে আজ আমি তোমার সঙ্গে বসে কথা কইছি , কথা কইতে কইতে এই যে এক কাপ চা , দুটো পান ,এক ছিলিম তামাক খাচ্ছি ,এ সবই গ্রহেরা আগে থাকতে বেঁধে রেখেছে ,আমার সাধ্য ছিল না এর এক চুল এদিক–ওদিক করি “|
আমরা কোন ঘটনার কি কোন ব্যাপারের এক চুল এদিক ওদিক করতে পারি কিনা ,তা বলবার কোন উপায় নেই | অদৃষ্ট ও পুরুষকার নিয়ে দ্বন্দ্ব চিরকাল চলে আসছে | পুরুষকারবাদী যেখানে বলেছেন যে , একটা কাজ তিনি নিজের চেষ্টায় করেছেন ,অদৃষ্টবাদী সেখানে বলেছেন ,সেই চেষ্টাটাই এক অদৃষ্টশক্তির প্রভাবে ঘটেছে |তবে মজা এইটুকু দেখা যায় যে ,তর্কে তিনি যত বড়ই অদৃষ্টবাদী বা পুরুষকারবাদী হোন, বাস্তবিক কাজের বেলায় ,অনেক সময় পুরুষাকারবাদী যিনি তিনি অদৃষ্টের উপর নির্ভর করে বসেন এবং অদৃষ্টবাদী যিনি তিনি পুরুষকার আশ্রয় করে কাজ করতে যান | তবে সেক্ষেত্রেও কেবলই নিজের মত ছাড়েন না | অদৃষ্টবাদী পুরুষকার আশ্রয় করবার সময় বলেন “এই যে আমি চেষ্টা করছি এইটেই অদৃষ্টের ফল |চেষ্টা করি কেন?চেষ্টা না করতেও ত পারতুম |” আবার পুরুষাকারবাদীর কাছে যখন কোন সুযোগ উপস্থিত হয় ,যা তাঁর জ্ঞানতঃ করা কোন কর্মের ফল নয় ,যখন তিনি হয়ত বলে ওঠেন ,”এই যে সুযোগ উপস্থিত হয়েছে ,এ আমি চেষ্টা করেছিলুম বলে ,নইলে এত লোক রয়েছে ,তাদের সুযোগ আসে না কেন?” মোট কথা , হার মানতে রাজি নন কেউই |দুজনেই নিজের মত বজায় রাখবেন |
বাস্তবিক ,অদৃষ্ট ও পুরুষকারের মধ্যে কোনটা বলবান ,সে বিচার এখানে করব না ,করে কোন লাভ নেই | মানুষকে অদৃষ্ট এ সমস্ত কাজে প্রেরণা দেয় ,কিংবা মানুষের পুরুষকার ও স্বাধীন ইচ্ছার স্থান আছে , সে তর্কের মীমাংসা কোন দিন হয়নি ,কোন দিন হবে কিনা সন্দেহ | কিন্তু ব্যবহারিক জগতে যে আমাদের দুটোকেই মেনে চলতে হয় ,তার কোন ভুল নেই |
হতে পারে, আমরা যাকে দৈব বলি ,সেটা আমাদের অজ্ঞতার ফল ,কিন্তু এটাও স্বীকার করতে আমরা বাধ্য যে , জ্ঞান আমাদের যত বেশিই হোক ,তার একটা সীমা আছে |ব্যবহারিক জগতে একেবারে পূর্ণ জ্ঞান অথবা পরিপূর্ণ অজ্ঞতা থাকতে পারে না |খানিকটা জ্ঞান ও খানিকটা জ্ঞানের অভাব মানুষের মধ্যে এ দুটো চিরকাল পাশাপাশি আছে ও থাকবে | কাজেই ,চিরকাল এমন কতকগুলো অভিজ্ঞতা মানুষের হবে ,যার উপর তার নিজের কোন হাত নেই এবং এমন আরও কতকগুলো ঘটনা ঘটবে ,যা সে নিজের স্বেচ্ছাকৃত কর্মের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন |
ফলিত জ্যোতিষের পেছনে যা উপপত্তি পাওয়া যায়, তা মানুষের ওপর গ্রহ শক্তি ও অন্যান্য শক্তির প্রভাবকে এইভাবে ব্যাখ্যা করে – পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে শত সহস্র বিভিন্ন জীবের সৃষ্টি হচ্ছে; ঠিক একই মুহূর্তে যে এত ভিন্নভিন্ন ধরণের জীবের সৃষ্টি হচ্ছে তা গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব জনিত হতে পারেনা, জীবের সৃষ্টির পেছনে অন্য কোনো শক্তি ক্রিয়াশীল | তবে জন্ম মুহূর্ত থেকেই যে মানুষের জীবনের ওপর গ্রহ শক্তির প্রভাব শুরু হয়ে যায় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই | কিন্তু একই মুহূর্তে যে সব মানুষ জন্মগ্রহন করছে তাদের ওপর তত্ত্বগতভাবে গ্রহ–নক্ষত্রের প্রভাব একই রকম হওয়া উচিত, একথা মনে হলেও বাস্তবে তা দেখা যায়না, অর্থাৎ তাদের সবার জীবন ধারা যে একই খাতে প্রবাহিত হয় তা নয় | আসলে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব শুধুমাত্র যে তাদের নিজস্ব শক্তির ওপরেই নির্ভর করে তা নয়, যে আধারের ওপর তারা কার্যকরী তার আভ্যন্তরীন শক্তি যা ঈশ্বর প্রদত্ত, জন্মস্থানের ভৌগলিক অবস্থান, পরিবেশগত বৈচিত্র ইত্যাদি বিষয়গুলির সঙ্গে গ্রহশক্তির নিরন্তর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া (inter action) মানুষের ভাগ্য নির্ণয় করে, তাই এই ভাগ্য বৈচিত্র্য |
ফলিত জ্যোতিষ বলতে আমরা সেই বিজ্ঞানকে বুঝি যা গ্রহ–নক্ষত্রের শক্তির সঙ্গে মানুষের প্রাণশক্তির সংঘাতের নিয়ম আবিষ্কারে ব্যাপৃত আছে | ফলিত জ্যোতিষ নির্দেশ করে মানুষের প্রাণ শক্তির ওপর গ্রহ–নক্ষত্রের শক্তি কিভাবে কাজ করবে এবং সেই ক্রিয়া কিভাবে অভিব্যক্ত হবে, যদি অন্য কোনো শক্তি তাকে প্রতিহত না করে | ফলিত জ্যোতিষ একথা কখনই বলেনা যে, মানুষের ওপর গ্রহ শক্তি ছাড়া অন্য কোনো শক্তির বিন্দুমাত্র প্রভাব নেই | এই প্রসঙ্গে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে একসঙ্গে বহু মানুষের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে | ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, জলপ্লাবন প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে যে অসংখ্য মানুষের একই সময়ে মৃত্যু হয়, সেক্ষেত্রে একথা বলা যায়না যে সেইসব মানুষদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত রাশিচক্রে প্রবল মারাক যোগ ছিল | একই ভাবে, ট্রেন, প্লেন ইত্যাদি বড় দুর্ঘটনা, মহামারী, পারমানবিক বিস্ফোরণ, প্রভৃতিতে একসঙ্গে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুকেও উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করা যেতে পারে | এই সমস্ত ক্ষেত্রে, কোনো অদৃশ্য শক্তি, যে শক্তি সম্বন্ধে এখনো পর্যন্ত আমাদের সম্যক কোনো ধারণা নেই, সেই শক্তি গ্রহশক্তিকে অতিক্রম করে কাজ করে, এবং তখন ব্যক্তিগত রাশিচক্রের ফলাফল অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে যায় |
ফলিত জ্যোতিষের স্বার্থকতা এইখানে যে, ফলিত জ্যোতিষ গ্রহের শক্তির পরিমাপ করতে শেখায় কিন্তু গ্রহশক্তি
ব্যতীত অন্য শক্তিকে অগ্রাহ্য করে নয় | সুপ্রাচীন এই ভারতবর্ষে, সেই পুরাকালে থেকে যেমন জ্যোতির্বিজ্ঞানের মধ্যে গ্রহ–নক্ষত্রের প্রভাবের আলোচনা করা হয়েছিল, তেমনি মন্ত্রশাস্ত্র, যোগশাস্ত্র প্রভৃতিতে মানুষের প্রাণের ওপর অন্যান্য শক্তির প্রভাবের ধারাও উল্লেখ করা হয়েছিল | তাই আমাদের দেশের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে গ্রহ–নক্ষত্রের প্রভাবের ফল যেমন বর্ণিত আছে, তেমনি অন্য শক্তির দ্বারা যে তার ব্যতিক্রম হতে পারে সে কথারও উল্লেখ আছে |
পরিশেষে বলা যায়, গ্রহ শক্তি মানুষের জীবনের একটি অন্যতম নির্ণায়ক হলেও তা একমাত্র নয় | জ্যোতিষ বিধি অনুসারে ব্যক্তিমানুষের ওপর কোনো অশুভ গ্রহের কুপ্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে বা শুভ গ্রহের মঙ্গলজনক প্রভাব বৃদ্ধি করে মানুষের ভাগ্যচক্রের কিছুটা পরিবর্তন নিশ্চয়ই সম্ভব, কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা কখনই বলা যায়না যে, গ্রহ শক্তিই মানুষের ভাগ্য স্থির করার এমাত্র চাবিকাঠি | সৃষ্টিকর্তার প্রতিটি সৃষ্টিই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যাধারী, তাই একই সময়ে, একই স্থানে জন্মগ্রহণ করা দুটি মানুষের ভাগ্য একইরকম হবে তা কখনই নিশ্চিত নয়. গ্রহের প্রভাবের সঙ্গে মানুষের নিজস্ব উপাদান মিলে তৈরি হয় মানুষের ভাগ্য | আর সর্বোপরি আছে কোনোএক অদৃশ্য অজানা শক্তি,মহাজাগতিক বা ঐশ্বরিক শক্তি, যাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কোনো জ্যোতির্বিদেরই নেই |