বিশ্বের প্রতিটি পদার্থের সঙ্গে ওপর সকল পদার্থের নিরন্তর শক্তির সংঘাত চলছে এবং এই পারস্পরিক ঘাত প্রতিঘাতের মাত্রা নির্ভর করে দুটি বস্তুর ভর, আয়তন, পারস্পরিক দূরত্ব, তাদের নিজস্ব গতি প্রভৃতির ওপর | এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য | সুতরাং এই বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুসারে এটি সত্য যে, পৃথিবীর ওপর মহাকাশের সকল জোতিষ্কমণ্ডলীর প্রভাব আছে |
পৃথিবী এবং গ্রহ নক্ষত্রের নিজস্ব গতি অনুসারে তাদের আপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রভাবেরও প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তন ঘটছে | এই আপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তনের কারণ হলো পৃথিবীর এবং গ্রহগুলির নিরন্তর স্থান পরিবর্তন | যেমন পৃথিবীর দুই প্রকার গতি আছে – ‘আহ্নিক গতি বা দৈনিক গতি’ অর্থাৎ নিজের কেন্দ্রে দৈনিক আবর্তন এবং ‘বার্ষিক গতি’অর্থাৎ সূর্যকে কেন্দ্র করে সূর্যের চারিদিকে বার্ষিক আবর্তন | সুতরাং পৃথিবীর এই দৈনিক ও বার্ষিক গতি এবং গ্রহসমূহের গতি, এই দুই শক্তি দ্বারাই পৃথিবীর ওপর জোতিষ্কমণ্ডলীর প্রভাব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে |
পৃথিবীর বার্ষিক গতির পথ নির্দেশ করে রবীমার্গ এবং দৈনিক গতির পথ নির্দেশ করে বিষুবরেখা | সুতরাং ফলিতজ্যোতিসের মূল ভিত্তি হলো এই দুই বৃত্ত, রবীমার্গ এবং আকাশ-বিষুব |
রবিমর্গের দুপাশে ৮ অংশের মধ্যে যে সকল নক্ষত্র আছে ,তারা রবিমর্গের উপরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে | অন্য যে সব নক্ষত্র আকাশে আছে ,তাদের কোন না কোন প্রভাব আছে বটে , কিন্তু তা এত সামান্য যে ,তাদের প্রভাব বাদ দিলেও কোন ক্ষতি হয় না | গ্রহগুলির মধ্যে প্রত্যেকে যখন রবিমর্গের যে অংশে থাকে তখন সেই অংশের উপর তার শক্তি প্রয়োগ করে | প্রত্যেক স্থানে আকাশ–বিষুবের যে বারটি বিন্দু আছে (যা থেকে রবিমর্গের উপর রেখা ক্ষেপ করে বারটি বিন্দু পাওয়া যায় ) তা দিয়ে সেই স্থানের উপর গ্রহ ও রাশির প্রভাব অভিব্যক্ত হয়ে থাকে |পৃথিবীর প্রত্যেক স্থানে তার আকাশের বিন্দুগুলির আপেক্ষিক অবস্থান স্থির; কিন্তু ,আকাশ–বিষুব এবং রবিমার্গ পৃথিবীকে বেড়ে ঘুরছে বলে ,আকাশ–বিষুব ও রবিমার্গ ঐ বিন্দুগুলি আপেক্ষিক অবস্থান প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তন করছে কাজেই ঐ বিন্দুগুলি দিয়ে পৃথিবীর ওপর মুহূর্তে মুহূর্তে নূতন নুতন প্রভাব অভিব্যক্ত হচ্ছে | ফলিত জ্যোতিষের মূল সূত্র এই | কাজেই ,ভাবগুলি যে বারটি বিন্দুমাত্র ,সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই |এই বারটি বিন্দু দিয়েই পৃথিবী তার প্রত্যেক স্থানে গগনচারীদের প্রভাব নিজের উপর আকর্ষণ করেন |
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, প্রত্যেক স্থানে ভিন্ন ভিন্ন সময় গ্রহ ও রাশির প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অভিব্যক্ত হচ্ছে এ কথা বোঝা গেলো ,কিন্তু তার দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন লোকের জীবন একই সময়ে একই পথে পরিচালিত না হয়ে ,ভিন্ন ভিন্ন পথে পরিচালিত হবে কেন ? এর বিস্তারিত আলোচনা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয় – সংক্ষেপে এইটুকু বলা যেতে পারে যে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্ম সময়ে জন্মস্থানের উপর গ্রহ ও রাশির যে প্রভাব পরে সেইটেই হচ্ছে তার বীজপ্রভাব –এ হিসাবে প্রত্যেকের বীজ বা মূলপ্রভাব অপরের বীজ হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র –কাজেই একই অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন লোকের জীবন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অভিব্যক্ত হয় | একটি উদাহরণ দিলে হয়তো ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার ভাবে বোঝা যেতে পারে | সমস্ত ঋতুতেই যে সব ফুলের সমাহার দেখা যায় তা নয় | শীতের মরসুমে রংবাহারি ফুলের শোভা, আবার গ্রীষ্মকালে সুগন্ধি জুঁই, বেল বা গন্ধরাজের সময় | জুঁই, বেল বা গন্ধরাজ শীতকালে প্রস্ফুটিত হয় না | ফুলের বীজের বিভিন্নতাই এর কারণ | প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে বীজের বিভিন্নতায় একই অবস্থায় ভিন্ন, ভিন্ন বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন আচরণ ঘটে | আর এটাই স্বাভাবিক |
বিজ্ঞানের ভিত্তির ওপর স্থাপিত বলে ফলিত জ্যোতিষের এই উপপত্তি একেবারে অযৌক্তিক বলে পরিহার করা যায় না | বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক সূত্র যেমন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়, ফলিত জ্যোতিষের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য | ফলিত জ্যোতিষের মূল এই উপপত্তি বিজ্ঞানভিত্তিক, তা অনুমান করা গেলেও , বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মাধ্যমে এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে |