প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্ত্য, দুই স্থানেই জ্যোতিষ শাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে | কিন্তু অনেকে জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বললেও কেউ কেউ জ্যোতিষকে গুপ্ত বিজ্ঞান (Occult Science ) বলে থাকেন অর্থাৎ কিনা জ্যোতিষের বিষয় বা নিয়মগুলো স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করা যায় না | গুপ্ত এবং বিজ্ঞান কথাটি পরস্পর বিরোধী | যেমন সোনার পাথর বাটী | যা এক কথায় অসম্ভব বস্তুকে নির্দেশ করে | |বিজ্ঞান কথাটির মানেই হচ্ছে ,যা আমরা প্রত্যক্ষ প্রমানের দ্বারা জানতে পারি বা যে জ্ঞান আমরা প্রত্যক্ষভাবে প্রমাণ করতে পারি |প্রত্যক্ষ বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা চলতে পারে |গুপ্ত বিজ্ঞান নিয়ে তা চলে না –কেন না ,গুপ্তবিজ্ঞানের বিষয়গুলি যুক্তিতর্কের নিয়মের বাইরে |
প্রকৃতপক্ষে গুপ্ত বিজ্ঞান বলে কোনো জিনিস পৃথিবীতে নেই | জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা থাকলেও তা হয়তো অনেক সময় অনেক মানুষ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে না , এবং ঠিক তখনি গুপ্ত বিজ্ঞানের প্রসংঙ্গটি আসে | আমরা এমন অনেক কলা বা শিল্প আয়ত্ত করতে পারি ,যার বিজ্ঞানটি আমাদের সম্পূর্ণ অজানা | কিন্তু তাহলেই কি কলা বা শিল্পের পিছনে কোন বিজ্ঞান নেই একথা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে? |প্রত্যেক কলা বা শিল্প এক একটি বিজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত |ফলিত জ্যোতিষ একটি কলা – এই কলাবিদ্যা দ্বারা গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান দিয়ে ব্যক্তির বা রাষ্ট্রের ভূত –ভবিষ্যৎ –বর্ত্তমান ফল বলা যায় |এই কলার পিছনে একটি সুসঙ্গত বিজ্ঞান নিশ্চয় আছে |
কিন্তু সেই বিজ্ঞানটাও অনেকের কাছে অজানা , এমনকি জ্যোতির্বিদরাও সব সময় যে মূল বিজ্ঞানটি বোঝে তবে জ্যোতিষ চর্চা করেন তাও নয় | ফলে বৃহত্তর আবিষ্কারের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে এবং যোগ বা মন্ত্র –শাস্ত্রের মত ,জ্যোতির্বিদ্যাও আমাদের দেশে গুরুমুখী হ‘য়েই রয়ে গেছে | তার ফলে ,তার বিজ্ঞানটি কখনই সুপরিণত হ‘তে পারেনি |ফলিত বিজ্ঞানের প্রয়োগটাকেই জ্যোতিষীরা খুব বেশি বড় ক‘রে দেখেছেন ,কেননা প্রয়োগে কৃতিত্বই ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার মূল | তার একটা মস্ত কুফল হয়েছে এই যে ,যে সব ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি ,ইচ্ছা করলে এবং চেষ্টা করলে ,এর বিজ্ঞানের দিকটা হয়তো আবিষ্কার করতে পারতেন এবং ফলিত জ্যোতিষের মধ্যে একটি বৈজ্ঞানিক ধারা এনে দিতে পারতেন ,তাঁদের মস্তিষ্কের সব শক্তি শুধু কতিপয় ব্যক্তির জীবনের ফল গণনায় ব্যয়িত ও ক্ষয়িত হয়ে গেছে | এই সমস্যা প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যেও সমান ভাবে সত্য |
ফলিত জ্যোতিষকে বৈজ্ঞানিক ধারায় আলোচনা করবার বিশেষ প্রচেষ্টা হয়নি | হয়ত ,কোথাও কোন ব্যক্তি কোন একটি বিশেষ বিষয়ে নিজের কাল্পনিক একটা মত দিয়ে গেছেন –কিন্তু ফলিত জ্যোতিষকে গোড়া থেকে বিজ্ঞানের উপর খাড়া করবার চেষ্টা কেউ করেননি | ফলে প্রত্যক্ষ বিজ্ঞান গুলির যেমন একটা সাধারণ মিলনভূমি আছে –যার উপর দাঁড়িয়ে তর্ক–বিতর্ক আন্দোলন–আলোচনা চলে –যাকে ভিত্তি ক‘রে গবেষণা সম্ভবপর হয় ফলিত জ্যোতিষের জ্ঞানে তেমন কোন সাধারণ মিলন–ভূমি গড়ে ওঠেনি |
বৈজ্ঞানিক মতে এ কথা আমরা কোনমতেই বলতে পারি না যে “গ্রহটি প্রাচ্যমতে মেষরাশিতে আছে এবং পাশ্চত্য মতে বৃষরাশিতে আছে ” কিংবা “প্রাচ্যমতে সিংহ লগ্ন ,পাশ্চাত্ত্য মতে কন্যা লগ্ন “| আমাদের দেশে এমন জ্যোতির্বিদও অনেক আছেন যাঁরা বলেন ,”যখন প্রাচ্যমতে বিচার করব তখন প্রাচ্য পুঁথিতে লেখা রাশিই ধরব ,এবং যখন পাশ্চাত্ত্য মতে বিচার করব তখন পাশ্চাত্ত্য পুঁথিতে লেখা রাশিই গ্রহণ করব |”তাঁদের মতে ,যে হিসাবেই বিচার করা যাক ফল হবে সেই একই | এ যে কি ক‘রে হ‘তে পারে তা আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির অগম্য |যদি মেষরাশি ,বৃষরাশির একই ফল হয় ,সিংহলগ্ন ,কন্যালগ্নে প্রভেদ না থাকে ,তাহ‘ লে যে কী ক‘রে বিচার হবে ,তা এই সব প্রতিভাশালী জ্যোতিষীরাই বলতে পারেন |
তাই রাশি নিয়ে এবং তাদের সম্মন্ধ ,,ভাব ও গ্রহ নিয়েও মতভেদের অন্ত নেই | ফলিত জ্যোতিষকে যদি বৈজ্ঞানিক আকার দিতে হয় ,তাহলে এই গোড়াকার জিনিষগুলির সংজ্ঞা পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করতে হবে ,এবং কোন কারণে ও কী উপপত্তির উপর ভিত্তি ক‘রে সংজ্ঞাগুলির নির্দেশ করা হচ্ছে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে |
জ্যোতিষের ব্যাপারে তিনটি বিভাগ আছে |প্রথম হচ্ছে এর গাণিতিক ভিত্তি ,দ্বিতীয় প্রভাব অবধারণ (calculation of forces ), তৃতীয় ফলাদেশ (interpretation ) গাণিতিক ভিত্তির মধ্যে কোন রাশিতে কোন গ্রহ বা ভাব আছে তা নির্দেশ করতে হয় ,কাজেই ,গোড়াতেই দরকার রাশি ,ভাব ও গ্রহের প্রকৃত ও অবিসম্বাদিত সংজ্ঞা নির্দেশ |
যেমন সায়ন রাশি ঠিক না নিরয়ণ রাশি ঠিক? যদি নিরয়ণ রাশি ঠিক হয় তাহ‘লে কেন নিরয়ণ রাশি ঠিক এবং সায়ন রাশি ঠিক নয় ,তার যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখান দরকার | তেমনি ভাব গণনা করবার যে সকল বিভিন্ন প্রণালী আছে তার মধ্যে কোন প্রণালীটি ঠিক ? যদি Semi Arc দিয়ে ভাব গণনাই ঠিক হয় ,তাহ‘লে তার যুক্তি নির্দেশ করা দরকার |তারপর ,ভাবগুলি কী পদার্থ তাও নির্ণীত হওয়া চাই | সেগুলি কী বিন্দুমাত্র ? না , রাশির মত ব্যাপক পদার্থ বিন্দুই যদি হয় ,তাহ‘লে তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য কী ? গ্রহগুলির ব্যাপার তারপর বোঝা দরকার |পাশ্চত্য জ্যোতির্বিদরা সাধারণতঃ রাহু ও কেতুকে গ্রহ ব‘লে স্বীকার করেন না ,কিন্তু প্রজাপতি (Uranus ) ও বরুণকে (Neptune ) গ্রহ ব‘লে ধ‘রে থাকেন |অপরপক্ষে ,ভারতীয় জ্যোতির্বিদদের মধ্যে অনেকেই প্রজাপতি ও বরুণকে গ্রহ বলে গ্রহণ করেন না ,কিন্তু রাহু কেতুকে গ্রহ ব‘লে ধরেন |
জ্যোতিষ যে বিজ্ঞানের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত একথা অনস্বীকার্য , কিন্তু এই সত্য সর্বজনগ্রাহ্য় এবং সর্বজনের বোধগম্য করতে গেলে জ্যোতিষের একেবারে গোড়ার বিষয়গুলো অর্থাৎ রাশি, ভাব, গ্রহ ইত্যাদির বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক নির্ণয় প্রয়োজন |