মন্ত্র বিনা ভগবানের আরতি করে কি ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাওয়া সম্ভব ?

মন্ত্র বিনা ভগবানের আরতি

আমরা সবাই আমাদের সাধ্য মতো দেবতার পুজো করি ,আরতি করি ,সন্ধ্যে জ্বালি | আমরা জানি ভক্তি ভাবে দেবতাকে আরতি করলে আমাদের জীবনের অনেক বাধা বিঘ্ন কেটে যায় | অনেক অশুভ দোষ ,অশুভ শক্তি দূর হয় | জীবনের অনেক দুর্ভোগ কেটে যায় | সন্তানের শিক্ষায় যদি কোনো বাধা থাকে সেটাও দূর হয়ে যায় | নতুন গৃহ লাভ হয় |এমনকি এই আরতি দর্শন করাও খুব শুভ |এমনকি দাম্পত্য কলহ ,কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভ হয় |

আমাদের সবার বাড়িতে সরস্বতী পুজো থেকে লক্ষীপুজো  আমরা সবাই  বাড়িতেই  করে থাকি | যে ব্যাক্তি খুব নাস্তিক তিনিও এই সব পুজো অর্চনা করে থাকেন | ভক্তি ভাবে ,শ্রদ্ধা সহকারে ,পবিত্র মনে ,বিনম্রতার সাথে আমরা সবাই পুজো করি আরতি করি |আমরা যে পত্র ,পুস্প ,ফল , জল দিয়ে ঈশ্বর কে আরাধনা করে থাকি | এইসব কিছুই শ্রী বিষ্ণুর কাছে যায় এবং তিনি তা গ্রহণ করেন |

আমাদের সবার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগেআরতিকাকে বলে ? সংস্কৃত শব্ধ আরাত্রিকা থেকে আরতি এই শব্দ টি এসেছে | আরতি শব্দের  “ ” –এর অর্থ ব্যাপ্তি |আররতিশব্দের অর্থ হলো প্রেম ,প্রীতি ,অনুরাগ |আরতির মাধ্যমে দেবতার প্রেম ,প্রীতি অনুরাগ বর্ধন করা যায় | শ্রী ভগবান কে যে দ্বীপ দিয়ে আরতি করা হয় সেই দ্বীপের শিখাহবে ১টি ,৩টি ,অথবা ৫টি | অথবা বহু সংখ্যক|

আরতির বিভিন্ন উপকরণ গুলি হলোপঞ্চপ্রদীপ ,কর্পুরদানি,জলপূর্ণ শঙ্খ,ধৌতবস্ত্র ,পুস্প ,চামর ,ধূপ ,দর্পন ইত্যাদি | এইসব জিনিস গুলি দিয়ে আরতির কিছু নিয়ম আছে | যেমনদেবতার পদতলে বার ,নাভি দেশে ২বার ,মুখ মন্ডলে ১বার ,এবং সর্বাঙ্গে সাতবার ,মোট ১৪ বার ঘোরাতে হয় | এবং ঘোরাবার নিয়ম হলো বামপদতল থেকে বৃত্তাকারে দক্ষিণাবর্ত্তে ডান পদতল পর্যন্ত | দেবতার মুখমণ্ডলে বার ঘোরানো যেতে পারে |  

আরতির উপকরণ গুলি প্রদর্শনের ক্রম আছে | প্রথমে দ্বীপমালা ,তার পর জলপূর্ণ শঙ্খ,তারপর শুদ্ধ বস্ত্র ,এরপর পল্লব এবং সব শেষে চামর দিয়ে আরতি করতে হবে | সব শেষে দেবতাকে প্রণাম করতে হবে |

আরতির সময় পূজক কে দেবতার শ্রী পাদপদ্মে বা শ্রীমুখাদি পবিত্র অঙ্গের দিকে তাকাতে হয় | এই আরতি হলো সাংকেতিক পুজো | পুজো আর আরতির উদ্দেশ্য আলাদা | আমরা পুজো করি আরতি করি দেবতার প্রসন্নতা লাভ করার জন্য | আরতির এইসব উপাচার গুলিকে আপাত দৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও এইগুলি সাধারণ নয় | এইগুলি আমাদের পঞ্চ ভূতের প্রতীক | অগ্নি ,জল ,আকাশ ,মাটি , বায়ুকে পঞ্চ ভুত বলা হয় |  

মন্ত্র বিনা ভগবানের আরতি 1            

যে সব উপাচার গুলি দিয়ে আরতি করা হয় সেগুলি দিয়ে আরতি করার কিছু তাৎপর্য আছে | পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে আরতির অর্থ হলোপ্রদীপের ৫টি শিখা আমাদের ৫টি ইন্দ্রিয়ের প্রতীক | ৫টি ইন্দ্রিয়কে এক করে তন্ময়চিত্তে  শ্রী ভগবানকে নিবেদন করা |এই পঞ্চপ্রদীপ দিয়ে আরতির পর কর্পূর দিয়ে আরতি করতে হয় | কর্পূর দিয়ে আরতির অর্থ হলো এই কর্পূরের ১টি মাত্র শিখা স্বয়ংজ্যোতি আর আত্মজ্যোতির সার্থক প্রতীক | এরপর আসে ধূপ দিয়ে আরতি করা | ধুপ নিজে পুড়ে গিয়ে সকল কে সুরভিত করে | এই ধূপ দিয়ে আরতির অর্থ হলো পুজোকের অগ্নি শুদ্ধি হয় | এরপর আসে দর্পন দিয়ে আরতি করার পালা | এই দর্পনের গুন্ হলো সত্য কে জাগিয়ে তোলা | এই দর্পনে প্রতিভাত হন দেবতা |

তারপর  শঙ্খ দিয়ে আরতি করতে হয় | শঙ্খ বলতে পানি শঙ্খ কে বোঝানো হচ্ছে | এই শঙ্খ হলো কম্বোজগোত্রের প্রাণীর দেহের আবরণ | শঙ্খের মধ্যে যে জল থাকে সেই জল হলো প্রাণশক্তির রূপক | আর শঙ্খ ধ্বনি হলো মন্ত্র শক্তির অনুরূপ | এই জলপূর্ণ শঙ্খ দিয়ে আরতির অর্থ হলো দেবতাকে দেহমনপ্রাণ সমেত মন্ত্র নিবেদন করা | এর পর আসে বস্ত্র দিয়ে আরতি করা | এই বস্ত্র হলো আবরণকারী |এটি হলো মহাশক্তির প্রতীক | মন স্থির হলে সেখানে সাম্যতা আসে | সব শেষ উপাচার হলো চামর |চামরের শান্ত ,সিন্গ্ধ,শীতল বাতাসে শ্রী ভগবানের কৃপা লাভ হয় | আমাদের শ্রী ভগবান প্রসন্ন হলে আমরা তার অপার করুনা লাভ করতে পারি |     

আমরা ভগবান কে যে আরতি করি , এই আরতির কোনো মন্ত্র হয় না | শ্রী ভগবানের এই আরতি করা সম্পন্ন হলে ইস্ট মন্ত্র জপ করতে পারেন | এটাতে ভগবান সন্তুষ্ট হন | আপনি যে দেবতার আরতি করছেন | আরতি শেষ হলে  সেই দেবতার জয়ধনী দিতে পারেন |

শাস্ত্র মতে আমরা ৫বার দেবতার আরতি করতে পারি |এই যে ৫টি আরতির রকম মাহাত্য আছে | খুব ভোর বেলায় সূর্য্য ওঠার ৪৫ মিনিট আগে আমরা যে দেবতার আরতি করি তাকে আমরা বলি মঙ্গলআরতি | এই যে মঙ্গল আরতির অর্থ হলো ভগবান কে ঘুম থেকে জাগানো এবং ভগবান কে শ্রদ্ধা নিবেদন করা | কর্পূর আর পবিত্র শঙ্খধ্বনি সহযোগে এই আরতি করতে হয় |   

এরপর যে আরতি আমরা করি তাকে বলে পূজা আরতি | ধুপ ,প্রদীপ ,শঙ্খধ্বনি এইসব নিয়ে পূজা আরতি করতে হয় | পূজা আরতির পর দুপুর বেলা  ভগবান কে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় | এই সময় যে আরতি করা হয়  তাকে বলে ভোগ আরতি | এই  ভোগআরতি করার সময় সব উপকরণ থাকলেও ধুপ আর দর্পন থাকবে না | সন্ধেবেলায় আমরা সবাই সন্ধ্যে জ্বালি | এই সন্ধ্যে বেলায় ভগবান কে যে আরতি করি তাকে বলে সন্ধ্যেআরতি | এই সন্ধ্যে বেলায় আরতি করার সময় আরতির সব উপকরণ থাকবে | শুধু তার সাথে থাকবে বাজনা | সন্ধ্যে বেলা বাজনা বাজিয়ে সন্ধ্যে আরতি করতে হবে |  

সারাটাদিনের শেষে আমরা যেমন বিশ্ৰাম নি | তেমন ভগবান কে আমরা শয়ন দি | যখন ভগবান কে শয়ন দিয়ে থাকি তখন যে আরতি করি তাকে বলে শয়ন আরতি | এই সময় আরতির সব উপকরণ থাকবে | শুধু কর্পূর আর শঙ্খধ্বনি কে বাদ দিতে হবে |  

আমাদের সবার বাড়িতে ঠাকুরের আসনে ইস্ট দেবতা ছাড়াও আর অনেক দেবতার ছবি বা মূর্তি থাকে | সেক্ষেত্রে আপনি কার আরতি আগে করবেন ? আমরা জানি ইষ্টেরমধ্যে সব ভগবানের বসবাস আছে | সেক্ষেত্রে আপনি সবার আগে ইষ্টের আরতি করবেন তার পর অন্য দেবদেবীর আরতি করুন

যাদের দীক্ষা হয়নি তারা কার আরতি সবার আগে করবেন ? আমরা জানি আমাদের সবার বাড়িতে সবার ইস্ট দেব দেবী আছেন | সেক্ষেত্রে আপনি সবার আগে ইস্ট দেবতার আরতি করুন | তার পর অন্য দেবতার আরতি করুন | নারী ,পুরুষ ,উচ্চবিত্ত ,নিম্নবিত্ত সবাই তাদের নিজ নিজ ঘরের ভগবান কে আরতি করতে পারেন | এই আরতির মধ্যে দিয়ে ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে মিলন হয় | পবিত্র  , শান্ত মনে আপনি যদি আরতি করেন এটাতে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি  ঘটে | ভগবান প্রসন্ন হয় |  

আর একটা কথা মনে রাখা দরকার আপনি যখন মা লক্ষীর আরতি করবেন তখন ঘন্টা বাজাবেন না | এটাতে মালক্ষী রুষ্ট হন | আরতির সময় আপনার কাছে যদি কোনো উপকরণ না থাকে সেক্ষেত্রে ঘি এর প্রদীপ দিয়েই আরতি করুন | ভগবান প্রসন্ন হবেন |

Author Bio

Related Posts