জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা দর্শনে কি ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় ?

জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা

জয় জগন্নাথ | তিনি রহস্যময় | তার নামের অনেক অর্থ আছে | তিনি রাজার রাজা | তেনার সব কিছু রাজসিক | অপরূপ তার সাজ | অপরূপ তার রূপ | সারা বছর ধরে ভক্তরা তার কাছে যান | তার একটু কৃপা পাবার জন্য | তিনি তো জগতের নাথ |

রহস্যময় শ্রী জগন্নাথের মহিমা বোঝা খুব কঠিন | তিনি যেন রহস্যাবৃত | বৈষ্ণব ,শৈব,শাক্ত ,আর শক্তি সবার দ্বারা তিনি পূজিত হয়ে আসছেন | জগন্নাথের পা নেই তবুও তিনি ভক্তের ডাকে তাঁর কাছে পৌঁছে যান | আবার জগন্নাথের হাত নেই তবুও তিনি ভক্তের বিপদের দিনে ভক্ত কে জড়িয়ে ধরেন | এমনকি ভক্তের দেয়া সব কিছু গ্রহণ করেন | শ্রী জগন্নাথের চোখের পলক নেই তাই হয়তো তিনি সব সময় ভক্তের দিকে নজর রাখেন | ভক্তের সব প্রাথর্না তিনি শুনতে পান | তিনি সব সময় তাঁর দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছেন ভক্তের দিকে |     

ভক্তের জন্য ভগবান আবার ভক্ত ছাড়া ভগবান সম্পূর্ণ হয় না |আমরা ভগবান কে দর্শন করার জন্য মন্দিরে যাই আর জগন্নাথ মহাপ্রভু ভক্তকে দেখার জন্য বাইরে বের হন | মহাপ্রভু জগন্নাথের কাছে সব ভক্ত সমান | উঁচু , নিচু ,ধনী, দরিদ্র সব ভক্ত তাঁর কাছে সমান | সব ভক্তকে তিনি সমান চোখে দেখেন | তাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন |

মহাপ্রভু জগন্নাথ সাধারণ জনগণের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে যান | তাই তো তাকে গণদেবতা বলি আমরা | আমাদের বারোটি মাসে বারো টি উৎসব হয় মহাপ্রভু জগন্নাথের উদ্দেশ্যে |( ) বৈশাখ মাসে অক্ষয় তৃতীয়া থেকে শুরু হয় জগন্নাথ দেবের চন্দন যাত্রা | ( ) জ্যৈষ্ট মাসে হয় স্নান যাত্রা | ( ) আষাঢ় মাসে হয় রথযাত্রা | ( ) শ্রাবন মাসে হয় ঝুলন যাত্রা | ( ) ভাদ্র মাসে হয় জন্মাষ্টমী | ( আশ্বিন মাসে অনুষ্ঠিত হয় বিজয় উৎসব | ( ) কার্তিক মাসে হয় রাশ উৎসব | (অগ্রহায়ণ মাসে হয় প্রথমা অষ্টমী উৎসব | ( ) পৌষ মাসে হয় বিগ্রহদের অভিষেক উৎসব | (১০) মাঘ মাসে হয় শীত বস্ত্র উন্মোচন উৎসব |(১১) ফাল্গুনমাসে দোলযাত্রা উৎসব | (১২) চৈত্র মাসে হয় দমন কার্পন্নোৎসব |

জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা 1

শ্রী জগন্নাথের এত গুলো উৎসব আছে | কিন্তু মহাপ্রভু শুধু মাত্র স্নান যাত্রা আর রথ যাত্রা এই দুটো উৎসবেই মন্দিরের বাইরে বের হন | ভক্তরা যাতে মহাপ্রভুকে দর্শন করতে পারে | স্বয়ং ভগবান ভক্ত কে দেখার জন্য মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে আসেন | ভক্তদের সব দুঃখ দূর করেন আর ভক্তর মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন |   

মহাপ্রভু জগন্নাথের স্নান যাত্রা বৈচিত্রপূর্ণ |স্নান যাত্রার পূর্বদিন থেকে শুরু হয় প্রস্তুতি | জগন্নাথ , বলরাম আর সুভদ্রা এই তিনজনকে ঠাকুরের বেদি থেকে নামিয়ে স্নান বেদিতে নিয়ে যাওয়া হয় | যেখানে সূর্যের আলো পরে না এমন একটি কূপ থেকে স্নানএর  জল নিয়ে আসা হয় | স্নান এর জন্য ১০৮ কলসি জল আনা হয় | আর এই জলেই মহাপ্রভু সপরিবারে স্নান করেন | সব কিছুই যেন ভগবানের পূর্বপরিকল্পিত | এই কূপের জলে স্নান করে ভগবানের শরীর খারাপ হয় | ১৫ দিন ধরে চিকিৎসা করা হয় | আর এই সময় মন্দিরের দরজা বন্ধ রাখা হয় | শুধু তাই নয় , এই সময় ঠাকুরের অন্নভোগ নিবেদন বন্ধ রাখা হয় | আর স্নান যাত্রার দিন ভগবানকে নানান ধরণের সুস্বাদু খাবার জগন্নাথকে নিবেদন করা হয় |        

এই যে জগন্নাথের স্নান যাত্রা | যে কোনো ব্যাক্তি এই স্নান যাত্রা দর্শন করলে তার সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয় | ভক্তর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় | তিনি আর দেহ প্রাপ্ত হয় না |        

স্নান যাত্রার পর আসে রথযাত্রার প্রসঙ্গ | এই রথযাত্রা আমাদের কাছে খুব বড়ো একটি উৎসব | আর এইদিনটিকে আমরা অত্যান্ত শুভ দিন হিসাবে মনে করি | কথিত আছে এই রথ তৈরির  অনেক প্রাচীন কাহিনী | দেবরাজ ইন্দ্রর সাথে বৃত্রাসুরের সংঘর্ষ হয় | এই যুদ্ধে বৃত্তাসুরের মৃত্যু হয় | আর বৃত্তাসুরের দেহটি চারটি ভাগে ভাগ হয় | আর এই প্রথম ভাগটি দিয়েই তৈরী হয় রথ |                     

এই  জগন্নাথ দেবের রথের নামনন্দীঘোষ ” | ৮৩২ টি টুকরো কাঠদিয়ে তৈরী হয় এই রথ | উচটা ৪৫ ফুট | ১৬টি চাকা | ৪টি ঘোড়া এই রথটি টানে | সুভদ্রার রথের নামদর্পদলন “| এই রথটি ৪৩ ফুট উঁচু |১২টি চাকা রথের | আর চারটি ঘোড়া এই রথটি টেনে নিয়ে যায় | বলভদ্রর রথের নামতালধ্বজ “|এই রথের উচ্চতা ৪৪ ফুট | ১৪টি চাকা রথের | চারটি ঘোড়া থাকে |

জগন্নাথদেবের স্নান যাত্রার পর সব দেবতাকে রথের ওপর তোলা হয় | আর তার পর পুরীর রাজা সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে দেন | তার পর জগন্নাথদেবের রথ টানা হয় | বহু বছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে | এই সময় জগন্নাথ মহাপ্রভুকে নানা বিধ ভোগ নিবেদন করা হয় | পুজো, আরতি করা হয় |      

জগন্নাথ মহাপ্রভুর প্রতিদিন পোশাকের রং পরিবর্তন করা হয় | তার সাথে সাথে সুভদ্রা আর বলভদ্রর পোশাকের রং পরিবর্তন করা হয় | ঠাকুরের সাজের পরিবর্তন করা হয় |                                           

শুধু তাই নয় শ্রী জগন্নাথের সপরিবারে প্রত্যেক মাসে বিভিন্ন বেশ ধারণ করেন | ১২টি মাসে ১২ রকম বেশ ধারণ করেন | যেমন ধরুন বৈশাখ মাসে খুব গরমের সময় ঠাকুর কে দুপুরে আর রাতে চন্দন মাখানো হয় | এই বেশ কে চন্দন লাগি বেশ বলা হয় | আর এই সময় ঠাকুরকে গামছা পরানো হয় |          

জ্যৈষ্ঠ মাসে গজানন বেশ বা গণপতি বেশ ধারণ করেন মহাপ্রভু |                               

আষাঢ়মাসে শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু সুনা রাজবেশ ধারণ করেন | জগন্নাথ ,বলরাম আর সুভদ্রা সোনার অলংকারে সজ্জিত হনআবার ভাদ্র মাসে মহাপ্রভু কালিয়দমন বেশ ধারণ করেন | আর অশ্বিন মাসে তিনটি বেশ ধারণ করেন | রাজবেশ , বিজয়া বেশ আর রাইদামোদর বেশ |     

কার্তিক মাসে মহাপ্রভু অনেক বেশ ধারণ করেন | যেমন ধরুন নাগার্জুন বেশ  ,থিয়াথিয়া বেশ ,বাঁকাচূড়া বেশ ,আদাকিয়া বেশ , ইত্যাদি সব থেকে বিখ্যাত বেশ হলো নাগার্জুন বেশ                 

জগন্নাথ ধাম বা পুরীধাম গিয়ে শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু কে ভক্তি ভরে একবার দর্শন করলে ভক্তের সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয় | ভক্তের জন্ম মৃত্যু ভয় দূর হয় | মানুষের মুক্তি লাভ হয় | শ্রী জগন্নাথ মহাপ্রভু তার ভক্তকে ধর্ম ,অর্থ ,কাম আর মোক্ষ এই চারি ফল প্রদান করেন | ভগবানের কাছে যে যা প্রাথর্না করেন তিনি সেটা পূরণ করেন | সংসারের মঙ্গল কামনা ,অর্থঐশ্বর্য লাভ ,শিক্ষাথীর সাফল্য লাভ , চরমতম বিপদ থেকে মুক্তিলাভ করেন ,সন্তান লাভ , কোনো প্রকার কঠিন অসুখ থেকে মুক্তি লাভ ,এই সব কামনায় তিনি পূরণ করেন | জয় জগন্নাথ

Author Bio

Related Posts