ফলিত জ্যোতিষের গ্রহগুলি কি আমাদের চৈতন্যের নির্দেশক ?

ফলিত জ্যোতিষের গ্রহগুলি

কেন্দ্র ত্রিকোণের ব্যাখ্যার অগ্রসর হবার আগে , কেন্দ্র ত্রিকোণ সম্বন্ধে সাধারণ জ্যোতির্বিদ এবং জ্যোতিষের শিক্ষানবীশের মনে যে ভ্রান্ত অথচ অস্পষ্ট ধারণা আছেসে বিষয়ে কিছু বলা দরকার 

কেন্দ্র ত্রিকোণ বলতে শুধু ভাবকেন্দ্র বা ভাব ত্রিকোণকেই বোঝায় না | ভাবের যেমন কেন্দ্র ত্রিকোণ আছে , রাশি গ্রহের তেমনি কেন্দ্র ত্রিকোণ আছে | তিনটি ব্যাপার নিয়ে জ্যোতিষের বিচার হয়ে থাকেরাশি, গ্রহ এবং ভাব | তার মধ্যে রাশিগুলি ব্যাপক পদার্থ ,গ্রহ ভাবগুলি বিন্দুস্বরূপ | গ্রহ ভাবের অবস্থান জানতে হলে ,তা রাশির অংশদি দিয়ে ব্যক্ত করতে হয় | রাশি ,গ্রহ ভাবের পরস্পরের উপর প্রভাবেই জ্যোতিষের বিচারের মূল | চারিটি কেন্দ্রের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা ত্রিকোণ আছে ,যাতে করে সর্ব্বসুদ্ধ বারটি ভাব হয়েছে | রাশি,গ্রহ ভাবগুলি কেন্দ্রে বিভাগ করে ,প্রত্যেক কেন্দ্রের ত্রিকোণগুলি এই হিসাবে লেখা যেতে পারে

রাশি কেন্দ্র

  ধনু                            মেষ                        সিংহ                                  মেষত্রিকোণ 

 মীন                           কর্কট                      বৃশ্চিক                               কর্কটত্রিকোণ 

মিথুন                          তুলা                         কুম্ভ                                  তুলাত্রিকোণ 

কন্যা                          মকর                         বৃষ                                   মকর ত্রিকোণ 

 

ভাব কেন্দ্র

নবম                            লগ্ন                        পঞ্চম                                   লগ্নত্রিকোণ 

দ্বাদশ                           চতুর্থ                      অষ্টম                                চতুর্থত্রিকোণ 

তৃতীয়                           সপ্তম                    একাদশ                              সপ্তমত্রিকোণ 

ষষ্ঠ                               দশম                     দ্বিতীয়                                দশম ত্রিকোণ 

 

গ্রহ কেন্দ্র

বৃহস্পতি                         রবি                       বুধ                                    রবিত্রিকোণ 

কেতু                              চন্দ্র                       রাহু                                  চন্দ্রত্রিকোণ 

বরুণ                             মঙ্গল                   প্রজাপতি                            মঙ্গল ত্রিকোণ 

শুক্র                             পৃথিবী                     শনি                                 পৃথিবীত্রিকোণ 

 

এই বিজ্ঞান যাঁরা প্রচার করেছিলেন সেই ঋষিদের যে এই কেন্দ্র ত্রিকোণ সম্বন্ধে স্পষ্ট জ্ঞান ছিল তার প্রমান পাওয়া যায়রাশি ভাবের শ্রেণীবিভাগ থেকেযা আজ পর্যন্ত কি প্রাচ্য কি পাশ্চাত্যজ্যোতিষের সব গ্রন্থেই সমানভাবেই স্বীকার করা হয়েছে | রাশির শ্রেণীবিভাগে ধনু, মেষ, সিংহকে অর্থাৎ মেষত্রিকোণকে এক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করে তার নাম দেওয়া হয়েছে অগ্নিতেমনি কর্কটত্রিকোণকে জল ,তুলা ত্রিকোণকে বায়ু এবং মকর ত্রিকোণকে পৃথিবী বলা হয়েছে | আবার কেন্দ্র রাশিগুলির নাম দেওয়া হয়েছে চর ,বাঁদিকের স্তম্ভের রাশিগুলিকে বলা হয়েছেদ্বিস্বভাব,আর ডানদিকের স্তম্ভকে বলা হয়েছে স্থির | ভাবের বেলায় তেমনি লগ্ন ,চতুর্থ, সপ্তম  ,দশমকে অর্থাৎ মাঝের স্তম্ভকে বলা হয়েছে কেন্দ্র , নবম,দ্বাদশ,তৃতীয়, ষষ্ঠ অর্থাৎ বাঁদিকের স্তম্ভটিকে বলা হয়েছে আপোক্লিম এবং পঞ্চম, অষ্টম ,একাদশ ,দ্বিতীয় অর্থাৎ ডানদিকের স্তম্ভটিকে বলা হয়েছে পণফর

ফলিত জ্যোতিষের গ্রহগুলি কি আমাদের চৈতন্যের নির্দেশক

কেন্দ্র ত্রিকোণের অর্থ ও তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বুঝতে গেলে ,রাশি,গ্রহ ভাবের অর্থ বোঝা প্রয়োজন এবং তা বুঝলেই প্রত্যেক স্থলে কেন্দ্র ত্রিকোণের অর্থ কী ধরণের এবং কেন বিভিন্ন হয়েছে তা সহজেই বোধগম্য হবে  |

দৃশ্য জগতে জড়পদার্থগুলিকে কেন্দ্র করেই জড়শক্তি কাজ করছে , কাজেই রাশির কেন্দ্রগুলি জড়পদার্থের দ্যোতক এবং ত্রিকোণগুলি জড়পদার্থের নির্দ্দেশক | আমাদের দৃশ্য জগতে জড়পদার্থের চারিটি মাত্র অবস্থা আছেকঠিন, তরল ,বায়বীয় এবং তৈজস (solid , liquid , gaseous  and  electrical ), জড়শক্তি তেমনি তিনরূপে অভিব্যক্ত পূর্ণক্রিয়াশীল, নিষ্ক্রিয় এবং মিশ্র | প্রত্যেক অবস্থার জড়পদার্থকে কেন্দ্র করে এই তিন শক্তি প্রকাশিত হয় ,কাজেই রাশি হিসাবে কেন্দ্র বলতে এই চারটি রাশিকে বুঝতে হবে ,যা জড়পদার্থের চারটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা নির্দেশ করে এবং যে গুলিতে শক্তির পূর্নক্রিয়াশীল অবস্থা দেখা যায় | মেষ,মকর,তুলা,কর্কট যথাক্রমে অগ্নি,পৃথ্বী ,বায়ু, জল বলে নির্দিষ্ট হয়েছে অর্থাৎ এগুলি যথাক্রমে জড়পদার্থের তৈজস (electrical ), কঠিন (solid ),বায়বীয়(gaseous ) এবং তরল(liquid ) অবস্থার জ্ঞাপক | এই চারটি চর অর্থাৎ শক্তির পূর্ণ ক্রিয়াশীল অবস্থার নির্দেশক | এই চার রাশির প্রত্যেকটির ত্রিকোণের অপর রাশিদুটি একই  পদার্থ নির্দেশ করে কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন শক্তির জ্ঞাপক | যেমন মেষত্রিকোণে মেষরাশি তৈজস পদার্থ এবং শক্তির পূর্নক্রিয়াশীল অবস্থা জ্ঞাপন করেধনুরাশিও তৈজস পদার্থই নির্দেশ করে কিন্তু শক্তি সেখানে মিশ্রআবার সিংহরাশিও তৈজস পদার্থের দ্যোতক কিন্তু শক্তি সেখানে নিষ্ক্রিয় | এইরূপ সর্বত্র অর্থাৎ প্রত্যেক কেন্দ্ররাশির নবমরাশি মিশ্রশক্তি এবং পঞ্চমরাশি নিষ্ক্রিয় শক্তি নির্দেশ করে

গ্রহগুলি আমাদের চৈতন্যের নির্দেশক | জড়পদার্থের যেমন চারটি স্তর আছেচৈতন্যের মধ্যেও তেমনি চারটি স্তর আছে | জড়পদার্থের মধ্যে যেমন দুটি স্তর স্থুল (কঠিন তরল ) এবং দুটি স্তর সূক্ষ্ম (বায়বীয় তৈজস ) | চৈতন্যের মধ্যেও তেমনি দুটি স্তর বহির্মুখী (objective ) এবং দুটি স্তর অন্তর্মুখী (subjective ) | বহির্মুখী স্তরদুটি বাইরের জড়পদার্থ এবং প্রাণশক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট | দর্শনশাস্ত্রে এই দুটি স্তরকে অন্নময় কোষ প্রাণময় কোষ বলে নির্দেশ করা হয়েছে | অন্তর্মুখী স্তর দুটি অভ্যন্তরীণ অনুভূতি জ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদর্শনশাস্ত্রে এই দুটি স্তরকে মনোময় বিজ্ঞানময় কোষ বলে নির্দেশ করা হয়েছে

 এই চারটি কোষের অর্থ একটু পরিষ্কার করে বোঝা দরকার | আমার চৈতন্যের কাছে চারটি ব্যাপার স্পষ্ট অভিব্যক্ত | অন্য কথায় আমার যে আমিত্ব তা চারিটি ব্যাপার নিয়েআমার দেশ, আমার প্রাণ ,আমার অনুভূতি এবং আমার জ্ঞান | এই চারটি পরস্পর সংশ্লিষ্ট হলেও , তারা যেন এক একটি স্বতন্ত্র বিভাগ | তারা যেন ঐক্যতান সঙ্গীতের চারটি বিভিন্ন যন্ত্র একই  সুরে বাঁধা | একটিতে ঘা পড়লে এর তিনটিতে সাড়া পরে বটে ,কিন্তু তবু তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু আছে | আমাদের চৈতন্যের এই চারটি স্তর আছে বলেই আমাদের ভাষার  শব্দগুলির মধ্যেও চারটি বিভাগ দেখা যায় | নিচে কতকগুলি উদাহরণ দিলাম ,এতে কোষ চারটির বুঝবার সুবিধা হবে |

 

হাত,পা, মুখ, টেবিল ,চেয়ার, পাথর ,মাটি প্রভৃতি শ্রেণীর শব্দগুলি অন্নময় কোষের সঙ্গে জড়িত

 খাওয়া, বলা ,চলা ,ফেরা প্রভৃতি শব্দগুলি প্রাণময় কোষের ব্যাপার নির্দেশ করে |

 দয়া, মায়া , স্নেহ ,প্রীতি, সুখ, দুঃখ ,বেদনা ,যন্ত্রনা প্রভৃতি শব্দগুলি মনোময় কোষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট |

 মহত্ত্ব  ,নীচতা ,সাধুতা ,মহানুভবতা ,ক্ষুদ্রতা ,ক্রিয়াশীলতা ,গতিশীলতা প্রভৃতি শব্দগুলি বিজ্ঞানময় কোষের সঙ্গে সম্বন্ধ

 গ্রহের মধ্যে রবি,চন্দ্র, মঙ্গল পৃথিবী বা লগ্ন এই চারটি গ্রহ আমাদের চৈতন্যের এই চারটি স্তরের কেন্দ্র ; রবি বিজ্ঞানের কেন্দ্র ,চন্দ্র অনুভূতির কেন্দ্র ,মঙ্গল প্রাণের  কেন্দ্র এবং পৃথিবী বা লগ্ন স্থুলদেহের কেন্দ্র |

 

প্রত্যেক স্তরে চৈতন্যের দুরকম প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় | একটি স্পষ্ট বা ব্যক্ত ,আর একটি অস্পষ্ট বা অব্যক্ত | ইংরেজিতে এই ব্যাপার ধরেই চিত্তকে conscious  subconscious  ,ধরে বিভেদ করা হয়েছে | প্রত্যেক স্তরে কেন্দ্র গ্রহের একপাশে তার প্রকাশ দিক আর একপাশে তার গোপন দিক |বিজ্ঞানময় কোষে রবি, বৃহস্পতি তার গোপন দিক   এবং বুধ তার প্রকাশ দিক | বৃহস্পতি , রবি ,বুধ এই ত্রিগ্রহ বিজ্ঞানময় কোষটি পূর্ণভাবে প্রকাশ করেছে | কেতু, চন্দ্র ,রাহু মনোময় কোষের যথাক্রমে গোপন দিক ,কেন্দ্র প্রকাশ দিক জ্ঞাপন করে এবং এই তিনটি গ্রহ একসঙ্গে মিলে সম্পূর্ণ মনোময় কোষকে নির্দ্দেশ করে | তেমনি বৃহস্পতি ,মঙ্গল রবি   এই ত্রিগ্রহ প্রাণময় কোষের এবং শুক্র ,পৃথিবী শনি এই ত্রিগ্রহ অন্নময় কোষের সূচক |

Author Bio

Related Posts