ফলিত জ্যোতিষের গ্রন্থগুলিতে যে রীতিতে প্রত্যেক ভাব থেকে বিচার্য বিষয়ের তালিকা দেওয়া হয়ে থাকে ,তা নিতান্ত বিশৃঙ্খল এবং গোলযোগপূর্ণ | কাজেই ভাববিচারের যে প্রথা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করার কোন চেষ্টা করা হয়নি | প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য কোনও জ্যোতিষের গ্রন্থেই এ সমন্ধে বিশেষ চেষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় না |
দু‘চারজন কৃতবিদ্য জ্যোতির্বিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করে দেখেছি ,তাঁদের বিশ্বাস “জ্যোতিষ গুপ্ত–বিজ্ঞান (occult science ) –তার মধ্যে যুক্তির চেয়ে প্রেরণারই আধিপত্য বেশি (more intuitional than rational ) “আমি একথা অস্বীকার করি | অবশ্য বিজ্ঞানমাত্রেই প্রেরণা বা ইনটুইশন এর স্থান আছে | গণিত বিজ্ঞানের মতো exact science এ ও প্রেরণা বা intuition দরকার | একটা অঙ্ক কেন যে একটা বিশেষ প্রণালীতে কষতে হবে ,তা সব সময়ে পরিষ্কারভাবে বোঝানো যায় না ,কিন্তু গণিতজ্ঞ দেখলেই বুঝতে পারেন অঙ্কটা সেই বিশেষ প্রণালীতে কষতে হবে | জ্যোতিষেও প্রেরণা বা intuition এর দরকার এই হিসাবেই |
গণিতে যেমন অঙ্ক কষবার বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম আছে,জ্যোতিষেও তেমনি ফল বিচার করবার পদ্ধতি, যুক্তি ও বিজ্ঞান দ্বারা সম্পূর্ণ অনুমোদিত ; তবে সে পদ্ধতির সমস্ত বিধি যুক্তি ও বিজ্ঞানের দিকে লক্ষ্য রেখে এখনো শ্রেণীবদ্ধ করা হয়নি | এই নিয়মগুলিকে বৈজ্ঞানিক আকার দিতে হলে , প্রথমেই কোন ভাবের কী অর্থ এবং সে অর্থ আমরা কি করে পাচ্ছি তা নির্ণয় করা দরকার | তারপর প্রত্যেক ভাবের অর্থগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাপার ধরে শ্রেণীবদ্ধ করা দরকার |
যেমন লগ্ন থেকে বিচার্য বিষয়গুলিকে যদি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাপার ধরে ভাগ করা যায় ,তাহলে এই রকম হবে – প্রেরণা বা intuition এর দরকার এই হিসাবেই | গণিতে যেমন অঙ্ক কষবার বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম আছে,জ্যোতিষেও তেমনি ফল বিচার করবার পদ্ধতি আছে যে যুক্তি ও বিজ্ঞান দ্বারা সম্পূর্ণ অনুমোদিত ; তবে সে পদ্ধতির সমস্ত বিধি যুক্তি ও বিজ্ঞানের দিকে লক্ষ্য রেখে এখনো শ্রেণীবদ্ধ করা হয়নি |
এই নিয়মগুলিকে বৈজ্ঞানিক আকার দিতে হলে , প্রথমেই কোন ভাবের কী অর্থ এবং সে অর্থ আমরা কি করে পাচ্ছি তা নির্ণয় করা দরকার | তারপর প্রত্যেক ভাবের অর্থগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাপার ধরে শ্রেণীবদ্ধ করা দরকার | যেমন লগ্ন থেকে বিচার্য বিষয়গুলিকে যদি ভিন্ন ভিন্ন ব্যাপার ধরে ভাগ করা যায় ,তাহলে এই রকম হবে –
আধ্যাত্মিক হিসাবে -আত্মা (নিজের অনুভূতি ) ,
পারিবারিক হিসাবে – (আমি অমুক লোক )
পারিপার্শিক হিসাবে – আমার দেহ
কালের হিসাবে – আমার স্থায়িত্ব বা প্রকাশ (আয়ু )
সামাজিক হিসাবে – আমার প্রতিষ্ঠা ,আমার চরিত্র
অন্যের মধ্যে আমার স্থান – আমার জাতি ,কুল প্রভৃতি
জগতের হিসাবে – আমার দেশ
দেশের হিসাবে – আমার বাসস্থান
নিজের স্থুল দেহের হিসাবে – আমার মাথা, আমার দেহের শক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি |
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা তা পরিষ্কার হবে ,কোন একটা জিনিষ বা ব্যাপার কোন ভাব থেকে বিচার করব ,তা ঠিক করতে হলে ,সে জিনিষটার সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারণা থাকা দরকার – সে সম্বন্ধে যদি ভুল জ্ঞান থাকে তাহলে ঠিক ভাবটি নির্ণয়েও আমাদের ভুল হবে | যেমন “পিতার ” বিচার কোন ভাব থেকে করতে হবে তা নির্ণয় করতে হলে ,”পিতা“র সঙ্গে পুত্রের সম্বন্ধ কী , তা আগে স্থির করা দরকার | “পিতা“কে যদি “মাতা“র স্বামী এই হিসাবে ধরা হয় ,তাহলে চতুর্থের সপ্তম অর্থাৎ দশমভাব থেকে বিচার করতে হবে | কিন্তু “পিতা“র এই সংজ্ঞা যে ভুল ,তা একটু বিবেচনা করলেই দেখা যাবে | মানুষ মাত্রেরই পিতামাতা আছে ,কিন্তু সকলের পিতামাতা বিবাহিত দম্পতি নয় | এমন দেশ আছে ,যেখানে সাময়িক বিবাহ প্রথা প্রচলিত – পাশ্চাত্য দেশগুলিতে একজন স্ত্রীলোক একাধিকবার বিবাহ করতে পারে এবং সেক্ষেত্রে প্রথম স্বামীর সন্তানের সঙ্গে ওই স্ত্রীলোকের দ্বিতীয় স্বামীর সম্বন্ধ পিতা–পুত্র সম্বন্ধ নয় | অতএব ,জ্যোতিষ শাস্ত্রের হিসাবে মাতার স্বামী এই অর্থ ধরে যদি কেউ দশম ভাবকে পিতৃস্থান বলেন ,তাহলে তা বিজ্ঞানসম্মত হবে না |
কেন না ,পিতৃত্ব ও মাতৃপতিত্ব অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধে আবদ্ধ নয় | কিন্তু জন্মদাতা অর্থাৎ যাঁর দেহকোষ ক্রমশ বেড়ে বেড়ে জাতক জন্মগ্রহণ করেছে ,”পিতা“র যদি এই অর্থ করা যায় ,তাহলে তা সর্ব্বদেশে সর্ব্বকালে প্রযোজ্য হতে পারে এবং সে অর্থ ধরলে বোঝা যায় যে নবমভাব যা লগ্নের কারণ বা উৎপত্তিস্থান তাকেই পিতৃভাব বলা সঙ্গত | সেইরকম “মাতা“কে যদি পিতার স্ত্রী এই অর্থ ধরে তৃতীয়ভাব থেকে বিচার করা হয় , তাহলে ভুল হবে –যে পরোক্ষভাবে জাতকের জন্মের সহায়তা করছে – অর্থাৎ সেক্ষেত্রে বা যার সাহায্যে জাতক বর্দ্ধিত হচ্ছে সেই মাতা |
এই হিসাবে চতুর্থভাবেই মাতৃভাব ,কেননা চতুর্থ ভাব কর্ম্মের বিরাম অথবা বিশ্রাম স্থান এবং সেইজন্য যা পরোক্ষভাবে জীবনের সাহায্য করে ,তার বিচার চতুর্থভাব থেকে করা উচিত |