রাশিচক্রটাকে লগ্ন থেকে শুরু করে বারটা ভাগে ভাগ করা হল কেন ?

রাশিচক্র

জ্যোতিষের রাশিনক্ষত্রগ্রহ দিয়ে যে কোন বিষয়ের ফলাফল বলতে গেলে ,দ্বাদশ ভাবের বিচার করতে হয় | যাঁরা জ্যোতিষের আলোচনা করেছেন ,তাঁরা জানেন যে কোষ্ঠী বিচারই  হোক ,প্রশ্নগণনাই  হোক, বাজার দরের উঠতিপড়তি নির্ণয়ই  হোক ,আর দেশের বা পৃথিবীর রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণীই   হোক ,সবই   দ্বাদশভাব নিয়ে বিচার করতে হয়এছাড়া উপায় নেই | দ্বাদশভাবের মধ্যে কোন ভাব থেকে কী বিচার করতে হবে ,তার ছোট বড় তালিকা প্রায় সব জ্যোতিষের গ্রন্থেই দেওয়া আছে এবং সে সম্বন্ধে মতভেদ বড় কম নেই | তাছাড়া ,একই জায়গা থেকে এমন দুটি জিনিষের বিচার করতে বলা হয়েছে ,যা আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষার্থীর  মনে একটা গোলযোগের সৃষ্টি করে | যেমন লগ্নে নিজের দেহের বিচার করতে বলা হয়েছে ,আবার মাথা ,মস্তিষ্কের বিচার করতেও বলা হয়েছে এবং চোখ,মুখ,কান,নাক সবই  যদিও  মাথার   মধ্যেই আছে ,তাহলে দ্বিতীয়ে চোখ,মুখ ,দাঁত,তৃতীয়ে নাককান বিচার করতে আদেশ করা হয়েছে ;আবার সেই দ্বিতীয়েই  গলা ,ঘাড়   এবং সেই তৃতীয়েই  স্কন্ধ ,ফুসফুস ,বাহু,হাত এদেরও বিচারের উপদেশ আছে |

কেন যে রাশিচক্রটাকে লগ্ন থেকে শুরু করে বারটা ভাগে ভাগ করা হল এবং কেন লগ্ন থেকে আত্মা ,শরীর, চতুর্থ থেকে মাতা,সপ্তম থেকে স্ত্রী ইত্যাদি বিচারের ব্যবস্থা হল ,তার কোন ব্যাখ্যা কোথাও নেই |

তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজতে হলে, একটা মানুষের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যাপারটা কী তা বুঝতে হবে | বোঝা বাইরের দিক থেকে হলে চলবে না ,প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের ভিতরকার অনুভূতির দিক থেকে করা চাই | প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন আর কিছুই নয় তার নিজের সঙ্গে অন্যের সংঘাত মাত্র | ততটুকুই তার জীবনের অনুভূতি যতটুকুতে সে নিজের কোন বস্তু ,ব্যক্তি বা পদার্থের সংস্পর্শে  আসে | সুষুপ্তির অবস্থায় তার জীবন থাকলেও ,অনুভূতি থাকে না এবং তা তার অনুভূতিময় জীবনের বাইরে পড়ে থাকে | কাজেই ,তার জীবন দেখতে গেলে ,আমাদের দেখতে হবে তার নিজের ব্যাপার অর্থাৎ তারআত্মা‘ (Self ), সে নিজে ছাড়া অন্য সব পদার্থ ,যাকে অন্য ভাষায়  ‘ বিষয়‘ ‘বাহ্যবস্তু‘ ‘বহির্জগৎপ্রভৃতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ তারঅনাত্মা ‘ (Non -Self ) এবং আত্মা অনাত্মার মধ্যে ঘাত–  প্রতিঘাত (action  and  reaction ) | এই ঘাত–  প্রতিঘাত দুরকম ভাবে প্রকাশ পায় ,তাদের নাম নামক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া , আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ অথবা সোজা কথায় মিলন বিচ্ছেদ বলা যেতে পারে | আত্মা এবং অনাত্মার  পরস্পরের উপর ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াই  মানুষের জীবনের সমষ্টি | এদের কেন্দ্র করেই মানুষের জীবন |

কোন ব্যক্তির জন্মকালে তার জন্মস্থানে রাশিচক্রের অবস্থানকে  যদি তার জীবন বলে কল্পনা  করা যায় ,তাহলে সেই রাশিচক্রের পূর্ব  দিগন্ত  অর্থাৎ যা তার জন্মের  সঙ্গে উদিত  হয়েছে সেইটেই  নির্দেশ করবে  তার নিজেকে  বাআত্মাকে ‘  –এবং ঠিক তার বিপরীত দিক অর্থাৎ পশ্চিম দিগন্ত যা অস্ত যাচ্ছে সেইটেই নির্দেশ করবে সে ছাড়া অন্য সব পদার্থকে তার বাহ্য জগৎকে অর্থাৎ ‘অনাত্মাকে’ | সেই রাশি-চক্রকে যদি মাঝ আকাশ থেকে একটি রেখা টেনে দু’ভাগে ভাগ করা যায় তাহলে সেই রাশিচক্রের অর্ধেকটা হবে পূর্ব এবং অর্ধেকটা হবে পশ্চিম এবং এই পূর্ব ও পশ্চিমের সংযোগস্থল হবে দু’জায়গায় -এক মাথার উপর মাঝ   আকাশে ,আর এক পায়ের নিচে উল্টো দিককার মাঝ  আকাশে | এই দুটি বিন্দুই পূর্ব এবং পশ্চিমের -আত্মার   এবং অনাত্মার   ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্থান | এই দুই জায়গাতেই পূর্ব এবং পশ্চিমের সংস্পর্শ হয়েছে | এই দুই জায়গার মধ্যে মাথার   উপরের মাঝ  আকাশ দৃশ্য এবং পায়ের নিচের উল্টো দিককার মাঝ  আকাশ অদৃশ্য | আত্মা ও অনাত্মার মধ্যে সংযোগ বা ক্রিয়াতে আত্মা এবং অনাত্মা উভয়েরই  প্রকাশ আছে এবং তাদের বিয়োগ বা প্রতিক্রিয়াতে উভয়েই উভয়ের কাছে লুপ্ত হয়ে যায় ,সেইজন্য মাথার   উপরের দৃশ্য মাঝ   আকাশকে আত্মা ও অনাত্মার ক্রিয়া বা সংযোগের নির্দেশক এবং পায়ের তলার মাঝ  আকাশটাকে আত্মা ও অনাত্মার প্রতিক্রিয়া বা বিয়োগের নির্দেশক বলা যেতে পারে |

তাহলে মানুষের জীবনের এই যে চারটি ব্যাপার () আত্মা () অনাত্মা () তাদের মধ্যে ক্রিয়া () তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ,এদের নির্দেশক চারটি বিন্দু রাশিচক্রে পাচ্ছি ,যথা () পূর্ব দিগন্ত () পশ্চিম দিগন্ত () মাথার   উপরের মাঝ আকাশ () পায়ের তলার উল্টো দিককার মাঝ আকাশজ্যোতিষের ভাষায় এদের নাম () লগ্ন () সপ্তম () দশম () চতুর্থযারা জ্যোতিষের একটুও আলোচনা করেছেন একথা তাদের বলা বাহুল্য |

জীবনের এই যে চারটি ব্যাপার এদের প্রত্যেকের তিন রকম অবস্থা আছে () উৎপত্তি কারণ বা বীজ অবস্থা () প্রকাশ অবস্থা () পরিণতি অবস্থা | যেমন কোন ব্যক্তির নিজের কারণ তার পিতা ,প্রকাশ সে নিজে ,এবং পরিণতি তার পুত্র | কিংবা সূক্ষ্ম জগতে তার কারণ তার গত কম্ম ,প্রকাশ তার বর্তমান অবস্থা এবং পরিণতি তার বর্তমান জন্মের কৃত কর্মে | আত্মার   যেমন এই তিন অবস্থা ,অনাত্মার ঠিক সেই রকম তিন অবস্থা আছেএবং তাদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এই চারটি ব্যাপারের  কারণ ,অভিব্যক্তি পরিণতি এই তিন রকম অবস্থাভেদ গ্রহণ করলে এই বারটি ভাব হয় | এই জন্য রাশিচক্রকে লগ্ন থেকে শুরু করে বারটি ভাবে ভাগ করা হয়েছে |

রাশিচক্রটাকে লগ্ন

তাহলে দ্বাদশভাবের মূল অর্থ নিম্নলিখিত ভাবে প্রকাশ করা যেতে পারে –

                           লগ্নআত্মা (নিজে ,স্বয়ং

                           দ্বিতীয়আত্মাঅনাত্মার সংযোগের ফল 

                           তৃতীয়অনাত্মার কারণ বা উপাদান 

                           চতুর্থআত্মাঅনাত্মার বিয়োগ 

                           পঞ্চমআত্মার পরিণাম

                           ষষ্ঠআত্মাঅনাত্মার সংযোগের কারণ 

                           সপ্তমঅনাত্মা (নিজে ছাড়া যা কিছু

                           অষ্টমআত্মাঅনাত্মার বিয়োগের ফল 

                           নবমআত্মার কারণ বা উপাদান 

                           দশমআত্মাঅনাত্মার সংযোগ 

                          একাদশঅনাত্মার পরিণাম 

                          দ্বাদশআত্মাঅনাত্মার বিয়োগের কারণ  

এই মূল অর্থ থেকে  কোন ভাব আমাদের জীবনের কোন ব্যাপারকে নির্দেশ করবে তা ঠিক করা যেতে পারে যদি আমরা জীবনের সেই ব্যাপারটি বিশ্লেষণ করে ,তার সঠিক অর্থ বুঝতে পারি |   

জীবাত্মার মধ্যে অনুভূতি দুরকম হয়ে দাঁড়ায়একআমিত্বের অনুভূতি ,অপরআমি ছাড়া অন্য পদার্থের অনুভূতিএই দুটি বস্তুর নাম আত্মা এবং অনাত্মা দেওয়া হয়েছে | এই আত্মা অনাত্মার অনুভূতি   পরস্পর জড়িত হয়ে থাকেমুক্ত জীবের মধ্যে আত্মার অনুভুতিই তীব্রএবং তাই একমাত্র অনুভূতি | বদ্ধজীবের মধ্যে অনাত্মার অনুভূতি প্রবল এবং আত্মার অনুভূতি অব্যক্ত | সেইজন্য মনকে দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে () ব্যক্তচেতন বা প্রকাশ মন (conscious  mind ) | () অব্যক্তচেতন বা গোপন মন (sub -conscious  mind  ) | যার অনুভূতি স্পষ্ট তাকেই  প্রকাশ মন বলা হয়এতসব অনাত্মার অনুভূতির যন্ত্র বা ইন্দ্রিয় বা করণ   (instrument  ) প্রকাশমন এবং আত্মার অনুভূতির যন্ত্র বা ইন্দ্রিয় বা করণ  গোপনমন ;এই হিসাবে নবম ভাব  থেকে গোপন মন (sub -conscious  mind  ) এবং তৃতীয় ভাব থেকে প্রকাশমন (conscious  mind  ) বিচার করা উচিত | বাস্তবিক কার্যক্ষেত্রেও দেখা যায় যে নবম ভাব  থেকে গোপনমনের অবস্থা মেলে ,যদি নবম স্থান বলবান হয় ,তাহলে জাতক যুক্তির চেয়ে প্রেরণা (instinct ) দিয়ে বেশি কাজ করে থাকেন , যদি নবম স্থান দুর্বল হয় এবং নানারকম বিনষ্ট  হয় ,তাহলে পক্ষাঘাত প্রভৃতি রোগ হয় ,কিন্তু যুক্তি ,বিচার বা জ্ঞান নষ্ট হয় না | তেমনি তৃতীয় ভাব বলবান হলে বাইরের দিককার   জ্ঞান খুব প্রবল হয়ে থাকে যুক্তি বা প্রত্যক্ষ প্রমান ছাড়া কোন জিনিষ সহজে বিশ্বাস হয় না এবং তৃতীয় ভাব  দুর্বল বা নানারকম বিনষ্ট হলে পাগল বা মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে থাকে

আত্মা যখন অনাত্মার সঙ্গে যুক্ত হয় ,তখনই  তাদের মধ্যে ক্রিয়ার অভিব্যক্তি | সেইটেই জাগ্রত অবস্থাসেই অবস্থায় আমাদের বহির্জগতের যা কিছু কর্ম ,বহির্জগৎ সমন্ধে যা কিছু জ্ঞানলাভ হয়ে থাকে | সেই জন্যই  দশম ভাবকে (যা আত্মা অনাত্মার ক্রিয়ার স্থান ) কর্মভাব বলা হয় | ষষ্ঠভাব  থেকে আত্মা অনাত্মার  সংযোগের যা কারণ বা করণ সেই সবের বিচার করতে হয় ,সেইজন্য আমাদের যত কর্মেন্দ্রিয় কামক্রোধাদি রিপু তা ষষ্ঠভাব  থেকে কল্পনা করতে হয় ,এবং দ্বিতীয়ভাবের কর্মের যা ফল অর্থাৎ বিদ্যা ,অর্থ ,সম্পদ প্রভৃতি বিচার্য |  

আত্মার সঙ্গে  অনাত্মার সংযোগের যে ক্রিয়া ,তার পিছনেই আছে প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে অনাত্মার বিয়োগ | চতুর্থ ভাব থেকে তার বিচার | এই যে অবস্থা এইটেই আমাদের জীবনের মধ্যে সুষুপ্তি  অবস্থা | সেই সময় অনাত্মা থাকলেও আমাদের কাছে তার অস্তিত্ব নেই | এই সুষুপ্তির কারণ ক্লান্তি ,অবসাদ ,ইন্দ্রিয় শক্তির বিলোপ প্রভৃতি | সুতরাং দ্বাদশ ভাব থেকেই ওই সবের বিচার করতে হবে | আবার এই সুষুপ্তির পূর্ণ পরিণতি মৃত্যু বা সমাধির বিচার হবে অষ্টম ভাব থেকে |

মানুষের জীবনের নানা দিক আছে ; আধ্যাত্মিক দিক, তার পারিবারিক দিক ,তার সামাজিক দিক প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে তাকে দেখা চলে | যখন যে দিক থেকে বিচার করতে হবে তখন সেই দিক থেকে এক এক ভাবের অর্থ করা দরকার | যেমন , যখন মানসিক বা আধ্যাত্মিক ব্যাপারের বিচার করা দরকার ,তখন যেমন নবম ভাবকে গোপনমন ,লগ্নকে আত্মা পঞ্চমকে আত্মার  স্ফূর্ত্তি বা পরিণতি ( যাকে সাধারণ ভাষায় প্রতিভা ,প্রেরণা প্রভৃতি বলা হয় ) বলে কল্পনা করতে হবে ,তেমনি পারিবারিক জীবনের বিচারের সময় লগ্নকে স্বয়ং ,নবমকে পিতা পঞ্চমকে পুত্র বলে ধরতে হবে | আবার সমস্ত রাশিকুণ্ডলীটিকে  যদি নিজের দেহ বলে কল্পনা করা যায় ,তাহলে লগ্নকে মাথা ,পঞ্চমকে হৃদয় এবং নবমকে ঊরুদেশ বলে মনে করতে হবে | আসল কথা, একটা জীবনকে  যখন যেদিক থেকে দেখা যাবে সেই হিসাবে একই  ভাবের অর্থ দাঁড়াবে ভিন্ন ভিন্ন

Author Bio

Related Posts